কর্ম পাগল বন্ধু এনামুল

 কর্ম পাগল বন্ধু এনামুল

(এনামুল স্মরণ

এনামুল হক তালুকদার 

সহকারী অধ্যাপক 

বিয়ানী বাজার সরকারি কলেজ, সিলেট। )

আর মোবাইল কলে বলবেনা নজরুল কবে আমাদের প্রমোশন হবে?

পর্ব-১

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আমার বন্ধুর জন্ম। এনামুল নায়কোচিত চেহারা, অল্পভাষী, মিষ্টি গলায় কথা বলে।পথ চলার গতি ধীর। তাঁর সাথে পথ চললে মনে হয় পথিক সবাই আগে চলে যাবে। গ্রামের আলপথে গাছ ও লতা পাতার ফাকেঁ সূর্যের লালিমার চেহারা যেন দোল খায়। গ্রামীণ পল্লী বালা কাঠের দরজায় উকিঁ দিকে দেখতে চাইলে ও দেখতে  পায় না, তাই দৌড়ে আলপথে নেমে আসেন। কারণ তিনি পিছনে ফিরে থাকান না।  নারী পুরুষের এ আকর্ষণ চিরকালীন।    জীবনে তাঁর কাছ থেকে কেউ উচ্চস্বর শুনেছে বলে আমার মনে হয় না। গ্রামে ছিল তাঁর এমনি সুনাম। প্রজন্মের পারিবারিক ঐতিহ্যে বেড়ে উঠা শৈশবে চলনে বলনে কোন আভিজাত্য ছিলনা। এ যেন সাধারণের এক আপনজন। আম জনতা ভাবতেন তিনিই একদিন এলাকার উন্নয়নের হাল ধরবেন। কৃষকের মুখে হাসি ফোটাবেন। আরো কত কল্পনা। প্রকৃতির নির্মম পরিহাস জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন প্রায়শই হয়ে উঠে না।


   ঠোঁটে মৃদু হাসি লেগেই থাকত। কলেজে কাজের ভিড়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর স্মিত হাস্যে এনাম দিত। এনাম শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও কলেজের কাজ বুঝতেন। এনাম স্যারদের কাজ না দেখলে বুঝা যাবে না কলেজের শিক্ষক কত কাজে ব্যস্ত থাকেন। অনার্সের পরীক্ষা চালাতে হলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। প্রশাসন মনে করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের আসন বিন্যাস করা সহজ। তা মোটেই নয় । এজন্য গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এনাম স্যারের চোখ দেখলেই বুঝা যায় পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে স্যারদের মেজাজ একটু রুক্ষ থাকে। পরীক্ষার শুরুর ১০/১৫ মিনিট পর এসে শিক্ষার্থী বলবে স্যার আমি আসন খোঁজে পাচ্ছিনা। আসন খোঁজে পায় না সে আবার পরীক্ষার্থী। আবার অনেক পরীক্ষার্থী বলবে স্যার আমার ত এই বিষয় নেই আমি পরীক্ষা দেব কেন? স্যার বলেন তোমার প্রবেশ পত্র পড়,  দেখ বিষয় কোডের পাশে লেখা আছে। এ ধরণের আজব শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা স্যারদের নিতে হয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার্থী বেড়েছে কিন্তু গুণগত শিক্ষা বহুদূর । স্যাররা কোয়ালিটি এডুকেশন ও ডিজিটাল কন্টেন্ট শতবার ক্লাসে বললে ও কে শুনে কার কথা। তবুও এনাম স্যারেরা আশায় বুক বাঁধেন “ আগামী প্রজন্ম হবে বিজ্ঞান মনস্ক জাতি।”

   চাকুরীর জন্য প্রতিনিয়ত বাস জার্নি যার নিত্য সঙ্গী। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পেশাজীবির জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা থাকে, স্কুল কলেজ শিক্ষকদের আলাদা পরিবহণ নেই। লক্কর ঝক্কর বাস, তার উপর নামে বিরতিহীন। ১ ঘণ্টর রাস্তা যেতে হয় ২ ঘণ্টায়। কোন দেশের উন্নয়ন জানতে হলে নাকি তাদের বাস ও রেলস্টেশন দেখে নিতে হয়।  যাক সে দিকে আজ নাই বলি। কলেজ যাত্রা নিয়ে এনাম স্যারদের উদ্বিগ্ন থাকতে হয়।    কথা হলেই বলত কাল কলেজে ক্লাস আছে, যেতে হবে কলেজে। ১৫ বছর যাবত একই বাস জার্নি আর সহ্য হয় না।   কলেজের বিভিন্ন প্রকারের কাজ তাঁর উপরেই পড়ত। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজেই সে পারদর্শী। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব কোন কাজের কথা বললে সে না করতে পারত না। কাজের ভারে সে জর্জরিত থাকলে ও কাউকে বুঝতে দিত না।  আমি  ও সে  ভিন্ন কলেজে হলে ও বিভিন্ন কাজে প্রায়শই একত্রিত হয়ে কাজ করতে হত। শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেয়া আমার জন্য জলবৎ  তরলং কিন্তু পরীক্ষক হয়ে উত্তর পত্র মূল্যায়ন করা বড়ই কঠিন কাজ। এনাম উভয় কাজই করত বিজ্ঞ হস্তে। 


কভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে বাসায় বোর্ডে পোস্টার পেপার প্রদর্শন করে অনলাইনে  ক্লাস নিয়ে বলত “ডিজিটাল স্যার আমার ক্লাস দেখে নিও।“  সত্যিই জাত শিক্ষক । এনাম ঢাকার বন্ধুদের থেকে শুনেছিল বিশেষ বর্ষে সবার প্রমোশন  হবে। আমাকে বলেছিল আমরা ৮ বছর থেকে সহকারী অধ্যাপক প্রমোশন হলে সরকার মহোদয়ের আর্থিক ক্ষতি নেই, তাই এবার সবার প্রমোশন হবে। আমরা সবাই আশায় ছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম বন্ধুর এনামুল হাসপাতালে ভর্তি জ্বর নিয়ে। টেস্টে রিপোর্ট আসল করোনা পজেটিভ। আল্লাহ মাফ কর আমাদের। এরকম রোগ আর  কাউকে দিও না। একই হাসপাতালে থেকে তিন জন নাবালক সন্তানকে কাঁদিয়ে এনাম চলে গেল পরপারে।(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) হাসপাতাল থেকে লাশ বাসার আসার পর তাঁর মেয়ের কান্না শুনে ত হয়ে গেলাম । “আমার বাবা কেনে ঘরে আসে না।“ (আমার বাবা কেন ঘরে আসে না) আমার বাবাকে এনে দাও। ওরা ২ বোন ও এক ভাই। আজ এতিম হলো । বাবার স্বাদ কী ওরা জীবনে পাবে। আমার কানে বার বার সেই সুর বেজে উঠে আমার বাবাকে এনে দাও। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব শব যাত্রা শেষ করে চলে এলাম । শুধু রেখে এলাম দহন ও  যন্ত্রণা ।


এনামুল থাকতেন সিলেট শহরের উপশহর এলাকায়। আমার আত্মীয় ও ঐ পাড়ায় থাকেন। উপশহরে গেলেই এনামের সাথে দেখা হত। বিশাল রাস্তার সরু পথ ধরে দুই বন্ধু হাটতাম কত কথা বলা হত , এর পর ও মনে হত অনেক না  বলা কথা রয়ে গেছে। এখন উপশহরে গেলে এনামের কথা মনে হলে চোখে জল চলে আসে । অবুঝ তিন শিশুর কথা মনে হলে থমকে দাড়াই। দোয়া করি আল্লাহ তাদের পিতৃ শোক সহ্য করার তৌফিক দাও। (আমীন )


  প্রিয় ২৪ বন্ধুরা এনামুলের মত আরো অনেক বন্ধু আমাদের ছেড়ে চলে গেল। রেখে গেল তাদের পরিবার ও এতিম সন্তান। 


তাঁদের জন্য আমরা কী করতে পারি?


যারা অসুস্থ তাদের জন্য কল্যাণ ফান্ডের কী খবর?


যারা এখনো প্রমোশন পায় নাই   কবে প্রমোশন হবে? 

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী করণীয়?


শেখ মোঃ নজরুল ইসলাম 

সহকারী অধ্যাপক বাংলা 

এম. সি. কলেজ, সিলেট।


Theme images by Storman. Powered by Blogger.