সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে শিক্ষার্থীদের সাথে একদিন।
শিক্ষা সফর ২০২৩
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
এইচএসসি ব্যাচ ২০২৩
এম.সি. কলেজ, সিলেট।
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর একটি
শিশিরবিন্দু। “
শনিবার সকালে কনিষ্ঠ এমসিয়ানদের
নিয়ে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয়
উদ্যান। শীতের যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন ছয় জন শিক্ষক
ও ১৭০ জন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য এত আগ্রহ শিক্ষার্থীদের
আগে কখনো দেখি নাই। তারা হলেন কোভিড ব্যাচের শিক্ষার্থী। যাদের অনেক সময় গেছে অনলাইন
ও অফলাইন ক্লাসে । শিক্ষা সফর মানে শিক্ষার্থীদের অনন্দ ও বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আর
শিক্ষকের অনেক বিধি নিষেধের কড়া শাসন। এম.সি. কলেজের নান্দ্যনিক প্রবেশপথে বাসের
সারি, সাদা ড্রেসে প্রজাপতিদের কলতান ভোরের ক্যাম্পাস অসাধারণ লেগেছে। গেইটের
সমাবেশে অধ্যক্ষ স্যার মিষ্টি সুভাষণের পর আচরণবিধি জানিয়ে দিলেন। শিক্ষার্থী
দলনেতা নাম ও রোল ধরে প্রতি বাসে আসন গ্রহণ করানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। অধ্যক্ষ স্যারের
নির্দেশনা কঠোর হওয়াতে নিমরাজী হয়ে বাসে ওঠা ছিল চোখে পড়ার মত । করতালির মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে বিদায়
জানিয়ে যাত্রা শুরু। এবারের যাত্রায় আমার সহকর্মী ছিলেন মনিকা রানী বনিক সহকারী অধ্যাপক
প্রাণিবিদ্যা, শৈলেন্দ্র মোহন সিংহ সহকারী অধ্যাপক উদ্ভিদ বিদ্যা, মোহাম্মদ আব্দুল
বাসিত সহকারী অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও মাসুদ
পারভেজ প্রভাষক মনোবিজ্ঞান। সহকর্মীদের ধৈর্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের গুণধর শিক্ষার্থীরা প্রতি পদে পদে কালক্ষেপন
করে আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
লম্বা যাত্রাপথ। চুনারুঘাট থেকে পাহাড়ী পথে প্রবেশ করতেই মুগ্ধতার ছোঁয়া। সবুজ ছায়ার
চা বাগান, গগণচুম্বী গাছের সারি, পাখির কলতান সবাইকে বিমোহিত করেছে। চুনারুঘাটের
চাবাগান মনে হয়েছে অন্য চা বাগানের চাইতে সাজানো গোছানো। চা বাগনের হীমশীতল বাতাস
পথিকের হৃদয়কে জুড়িয়ে দেয়। চোখ ধাঁধানো এত সৌন্দর্য দেখলে মনে হয় প্রকৃতি নিজ হাতে
সাজিয়েছেন এ বাগানকে। এ দৃশ্য দেখে মনে পড়ে
যায়
“ হায়রে আমার মন মাতানো দেশ
হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি
রূপ দেখে তোর কেন আমার
নয়ন ভরে না
তোরে এত ভালোবাসি তবু
পরাণ ভরে না”
আসলেই চা বাগানের প্রকৃতি
অনেক সুন্দর।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান- বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক উদ্যান। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ/সংশোধন আইনের বলে ২৪৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে "সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান"
প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই উদ্যানে সাতটি পাহাড়ি ছড়া আছে, সেই থেকে এর নামকরণ সাতছড়ি (অর্থ: সাতটি ছড়াবিশিষ্ট)। সাতছড়ির আগের নাম
ছিলো "রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট"।
অবস্থান
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নের রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে এর
দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। উদ্যানের কাছাকাছি ৯টি চা বাগান আছে। উদ্যানের পশ্চিম দিকে
সাতছড়ি চা বাগান এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা বাগান অবস্থিত। উদ্যানের
অভ্যন্তরভাগে টিপরা পাড়ায় একটি পাহাড়ী উপজাতির ২৪টি পরিবার বসবাস করে। এই ক্রান্তীয় ও মিশ্র চিরহরিৎ পাহাড়ী বনভূমি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং উন্দো-চীন অঞ্চলের
সংযোগস্থলে অবস্থিত।
উদ্ভিদবৈচিত্র্য
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে
রয়েছে প্রায় ২০০'রও বেশি
গাছপালা। এর মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, গর্জন ,চাপালিশ, পাম, মেহগনি , কৃষ্ণচূড়া,
ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধাজারুল, আওয়াল, মালেকাস, ইউক্যালিপটাস,
আকাশমণি, বাঁশ, বেস-গাছ
ইত্যাদির বিশেষ নাম করা যায়।
জীববৈচিত্র্য
এ উদ্যানে ১৯৭ প্রজাতির
জীব-জন্তু রয়েছে। এর
মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬
প্রজাতির উভচর। আরও
আছে প্রায় ১৫০-২০০ প্রজাতির
পাখি। এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। বনে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, শিয়াল, কুলুবানর, মেছোবাঘ, মায়াহরিণ ইত্যাদি; সরীসৃপের মধ্যে সাপ ; পাখির মধ্যে কাও ধনেশ, বনমোরগ, মালমাথা, কুচকুচি, কাঠঠোকারা, ময়না, ভীমরাজ, ধলাকোমর, শ্যামা, ঝুটিপাঙ্গা, শালিক, হলদে পাখি, টিয়া প্রভৃতির আবাস
রয়েছে। এছাড়া গাছে গাছে আশ্রয় নিয়েছে অগণিত
পোকামাকড়, ঝিঁঝিঁপোকা তাদের অন্যতম।
শকুনের নিরাপদ এলাকা
শকুনের নিরাপদ এলাকা-১
তফসিল অনুসারে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান শকুনের জন্য নিরাপদ বলে ঘোষিত।
নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প
"নিসর্গ"
নামের একটি এনজিও, বন বিভাগের পাশাপাশি, তাদের 'নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প'-এর অধীনে এই জাতীয় উদ্যানের দায়িত্ব পালন করে। নিসর্গের তত্ত্বাবধানে বন
সংরক্ষণ ছাড়াও, বনে ইকো-ট্যুর পরিচালিত হয়। এছাড়া নিসর্গ
প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন শৌখিন দ্রব্যাদির বিক্রয় হয়ে থাকে। সাতছড়ি জাতীয়
উদ্যানে এনজিও প্রকল্পের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের জন্য "স্টুডেন্ট
ডরমিটরি" আছে। যেখানে মাত্র ১২৫ টাকায় রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ক্ষুদে
বিজ্ঞানীদের নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে সময় কিভাবে চলেছে টেরই পাইনি। তবে বড় ভাল
লেগেছে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের এত সৃজনশীল প্রতিভা
না দেখলে বুঝা যায় না। যেমন সঞ্চালনা তেমন বক্তৃতা সেই রকম আবৃত্তি ও গান। সিলেট বিভাগের অতি মেধাবী শিক্ষার্থী তারাই।
শিক্ষা সফর সম্পাদনের জন্য অরিত্র, তামিম, মাহের, ছাহাত আহমদ রিফাত, তানিম, জুবায়ের, রাইয়ান, আরাফাত, সৌরভ
সৃজা, দৃষ্টি, বিলাস, অংকন, পিনাক, পূজা, বর্ণা, মুন্তাহা, অর্পিতা, সালওয়া,
অন্তু, অপু, নিলয়, অক্লান্ত শ্রম দিয়েছে। ভ্রমণসঙ্গী
সবাই তাদের কথা স্মরণ রাখবে।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিল
অরিত্র বিশ্বাস, অংকন, অনামিকা চক্রবর্তী দৃষ্টি, বিদিতা চক্রবর্তী সৃজা, পারমিতা
বিশ্বাস শ্রেয়া, আফসারা হক তরী, ঐশিকা
দাশ, স্রোতস্বিনী স্নেহা, সঞ্চিতা পাল
বর্ষা, নবনীতা দাশ পুশন, পূজা সামন্ত,
পিনাক দ্যুতি সিনহা, বনশ্রী দাশ, পল্লবী, বিলাশ, আহমেদ মাহের,
তামিম আহমেদ ও আরো অনেকে।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ওয়াচ
টাওটার প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রকৃতির বিস্ময়, নানান জাতের বৃক্ষারাজি
ও প্রাণি এ বনকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ভ্রমণবিলাসীদের অন্যতম
সুন্দর স্থান।
সবার কল্যাণ হউক।
শেখ মোঃ নজরুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক
এম.সি. কলেজ, সিলেট।